বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৮

চরম ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

ভুগাঠনিক/টেকটনিক বৈশিষ্ট্য: বাংলাদেশ ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে বংগোপসাগরের মাথায় অবস্থিত। টেকটনিক্যালি বাংলাদেশ ভারতীয় প্লেটের উত্তরপূর্বাঞ্চলে এবং তিনটি প্লেটের (ভারতীয় প্লেট,ইউরোসিয়ান প্লেট এবং বার্মিজ মাইক্রোপ্লেট)-এর সংযোগ¯হলে অবস্থিত। এই তিনটি প্লেট দুটি প্লেট বাউন্ডারী উৎপন্ন করেছে । ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেট বাউন্ডারী উত্তরে হিমালয় আর্ক এবং ভারতীয় ও বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) প্লেট বাউন্ডারী পূর্বে বার্মা আর্ক উৎপন্ন করেছে । ভারতীয় প্লেটটি বছরে ৬ সে.মি উত্তরপূর্ব দিকে সরে আসছে এবং যথাক্রমে উত্তরে ইউরেশিয়ান (৪৫ মি.মি/বছর) এবং পূর্বে বার্মিজ প্লেটের (৩৫ মি.মি/বছর)নীচে ঢুকে পড়ছে। ক্রমাগত এই গতির ফলে সক্রিয় ফল্ট তৈরী হয়েছে। একটি  ফল্ট ভারতীয় এবং ইউরেশিয়া বাউন্ডারীতে (হিমালয়ের পাদদেশে) আটকে আছে (১৯৩৪ সাল থেকে)। এই ফল্ট জোনে প্রচন্ড শক্তি সঞ্চয় হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে প্রচন্ড শক্তির তান্ডবে ফল্টটি সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে অথাৎ বড় মাত্রার ভুমিকম্পের আশংকা রয়ে গেছে।

সক্রিয় ফল্টেসমুহের কারনে ( রিজনাল স্কেলে) জন্য বাংলাদেশ ও এর আশে পাশের অঞ্চল মাঝারী থেকে তীব্র ভুমিকম্পের ঝুকিতে রয়েছে। সক্রিয় ফল্টগুলোর মধ্যে রয়েছে ডাউকী ফল্ট, যা পূর্ব-পশ্চিমে  প্রায় ৩০০ কি.মি পর্যন্ত বিস্তত এবং শিলং মালভুমির(মেঘালয়-বাংলাদেশ সীমানা)  দক্ষিনপ্রান্তে অবস্থিত। মধুপুর ফল্ট যা উত্তর-দক্ষিণে ১৫০ কি.মি পর্যন্ত বিস্তৃত এবং মধুপুর গড় ও যমুনা প্লাবন সমতলভুমির মাঝে অবস্থিত। আসাম-সিলেট ফল্ট যা উত্তরপূর্ব থেকে দক্ষিণপশ্চিমে প্রায় ৩০০ কি.মি পর্যন্ত বিস্তৃত এবং সুরমা বেসিনে অবস্থিত। চট্টগ্রাম-মিয়ানমার প্লেট বাউন্ডারী ফল্ট যা চট্টগ্রাম-মিয়ানমার সৈকতের সমান্তরালে প্রায় ৮০০ কি.মি পর্যন্ত বিস্তত।

চিত্র: বাংলাদেশের অব ও টেকটনিক বৈশিষ্ট্য

তাছাড়া বঙোপসাগরে চারটি সক্রিয় উৎসের কারনে রিক্টারস্কেলে ৭ মাত্রারও অধিক শক্তিশাত্রার সুনামীর আশংকাও রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কতৃক তৈরীকৃত ভুমিকম্পনপ্রবন এলাকার মানচিত্র বা সিসমিক জোনিং মানচিত্রে বাংলাদেশের ৪৩ ভাগ এলাকা উচ্চ ঝঁকিপূর্ণ অঞ্চল (জোন-১), ৪১ ভাগ মাঝারী ঝুকিপূণ অঞ্চল (জোন-২) এবং বাকী  ১৬ ভাগ কম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল (জোন-৩) হিসাবে চিহিত করা হয়েছে।

জোন-১ : পঞ্চগড়,রংপুর,গাইবান্ধা,কুড়িগ্রাম,জামালপুর,শেরপুর,ময়মরসিংহ,নেত্রকোনা,সুনামগঞ্জ,কিশোরগঞ্জ,মৌলভীবাজার,সিলেট,হবিগঞ্জ,ব্রাক্ষণবাড়িয়া,ঠাকুরগাঁও-এর কিছু অংশ,সিরাজগঞ্জ,টাঙাইল,রাঙামাটি,খাগড়াছড়ি এবং কক্সবাজার।

জোন-২
রাজশাহী,নাটোর,মাগুরা,মেহেরপুর,কুমিল্লা,ব্রাক্ষণবাড়িয়া,ফেনী এবং ঢাকা

জোন-৩
বাংলাদেশের সব দ্বীপ এবং চর অঞ্চল। বরিশাল এবং পটুয়াখালী ।
( সুত্র: ডেইলি স্টার, আগষ্ট ১১,২০০৯)

বাংলাদেশে ভুমিকম্পের কারণ:  বাংলাদেশ ও এর আশেপাশে যে ভুতাত্ত্বিক চ্যুতি বা ফল্টসমুহ সক্রিয় রয়েছে,সেগুলোর নড়াচড়া ফলে বিভিন্ন মাত্রার ভুমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ ও এর আশেপাশের অঞ্চলসমূহ। সক্রিয় ফল্ট জোনগুলো  হলো-

(১)    বগুড়া ফল্ট জোন
(২)    রাজশাহীর তানো ফল্ট জোন
(৩)    ত্রিপুরা ফল্ট জোন
(৪)    সীতাকুন্ড-টেকনাফ ফল্ট জোন
(৫)    ডাউকি ফল্ট জোন (হালুয়াঘাট ফল্ট)
(৬)    ঢুবরী ফল্ট জোন
(৭)    চটগ্রাম ফল্ট জোন
(৮)    শাহজীবাজার ফল্ট জোন  (আংশিক ডাউকি ফল্ট) এবং
(৯)    রাঙামাটি ফল্ট জোন (বরকল)


বুধবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৮

ভূমিকম্প

ভূমিকম্প একটি বির্পযয়। ভু-ত¦কের নীচে প্রচন্ড শক্তি সঞ্চিতথাকে। এই শক্তি যখন ভূ-পৃষ্ঠে হঠাৎ অবমুক্ত হয়, তখন ভু-পৃষ্ট প্রচন্ড জোরে কেঁপে উঠে। ভূ-পৃষ্ঠের এই হঠাৎ কেঁপে উঠাকে ভূমিকম্প বলে।
উইকিপিডিয়ার বাংলা সংস্করণে ভূমিকম্পের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা নি¤œরুপ:

ভূ-অভ্যন্তরে শিলায় পীরনের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে,সেই শক্তির হঠাৎ মুক্তি ঘটলে ভূ-পৃঠে ক্ষনিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূ-ত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এইরুপ আকস্মিক ও ক্ষন¯হায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প বলে।

ভুমিকম্পের কারণ : ভুমিকম্পের কারণ বহুবিধ হতে পারে।
১.    ভূ-ত্বকে ফল্ট বা চ্যুতি ।
২.    আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুপাত।
৩.    পাহাড়ধস এবং ভুমিধস ।
৪.    তাপ বিকিরন
৫.    ভূগর্ভˉহ বাষ্প
৬.    হিমবাহের প্রভাব
৭.    ভ’-পৃষ্টে
বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ বা বোমার কার্যকারীতা পরীক্ষা।
৮.    ভু-গর্ভ¯হ খনিতে কৃত্রিম
বিস্ফোরণ ইত্যাদি।

১ থেকে ৬ নম্বর কারণগুলি প্রাকৃতিক এবং বড় মাত্রার ভুমিকম্পের সৃষ্টি করে। ৭ ও ৮ নং কারণগুলি  মানুষের সৃষ্টি এবং ছোট থেকে মাঝারী মাত্রার ভুমিকম্পের উৎপত্তি করে। পৃথিবীর বড় বড় ভুমিকম্প(প্রায় ৮০%)-এর পেছনে রয়েছে ফল্ট বা চ্যুতি দিয়ে অকল্পণীয় শক্তির হঠাৎই অবমুক্তি। এই ফল্ট বা চ্যুাতি কি এবং কিভাবে তা ভূমিকম্পের সাথে সম্পর্কীত তা বুঝতে হলে, আমাদের প্রথমেই আলোচনা করতে হবে- পৃথিবীর স্তরবিন্যাস, প্লেট টেক্টটনিক তত্ত্ব এবং ফল্টের উৎপত্তি ও প্রকারভেদ।

পৃথিবীর স্তরবিন্যাস:
পৃথিবীকে প্রধানত চারটি স্তরে ভাগ করা হয়ে থাকে-
১.    ক্রাস্ট বা কঠিনত্বক ।
২.    ম্যান্টেল।
৩.    আউটর কোর বা
বহি: স্থ মূল ।
৪.    ইনার কোর বা  অন্ত:মুল ।


ক্রাস্ট : পৃথিবীর উপরের দিকে  কঠিন আবরনকে ক্রাষ্ট বলে। এই ক্রাষ্ট আবার দুটি অংশে বিভক্ত। কন্টিন্টোল ক্রাস্ট বা মহাদেশীয় কঠিনত্বক এবং ওসোনিক বা মহাসাগরীয় কঠিন ত্বক। পৃথিবীর ক্রাষ্টের ৭১ শতাংশই মহাসাগরীয় ক্রাস্ট আর বাকী ২১ শতাংশই মহাদেশীয় ক্রাষ্ট। মহাদেশীয় ক্রাষ্ট আগ্নেয়শিলা যেমন গ্রানাইট দ্বারা গঠিত এবং মহাসাগরীয় ক্রাষ্ট পাললিক এবং ব্যাসাল্ট শিলা দ্বারা গঠিত। মহাদেশীয় কঠিনত্বকের গড় ঘনত্ব ৩গ্রাম/সে.মি  অন্যদিকে মহাসাগরীয় কঠিনত্বকের গড় ঘনত্ব ২.৯গ্রাম/সে.মি। ক্রাস্টে তাপমাত্রা ২০০-৪০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। মহাদেশের নীচে ক্রাস্টে পুরুত্ব প্রায় ৬০ কি.মি এবং মহাসাগরের নীচে ক্রাস্টে পুরুত্ব ৫ কি.মি। এই ক্রাস্ট সদা সঞ্চারণশীল। ট্যাকটনিক প্লেট (অন্যত্র আলোচনা করা হয়েছে) এই স্তরেই বিদ্যমান । গাছ পালা, পাহাড়-পর্বত,নদী সবই ক্রাস্টের উপর অবˉিহত।

ম্যান্টেল : পৃথিবীর ২য় স্তর। ক্রাস্টের নীচেই এর অবˉহান। এই সÍর দুটি অংশে বিভক্ত- লিথোসস্ফেয়ার বা শিলামন্ডল এবং স্থানোসস্ফেয়ার । সকল স্তরের চেয়ে ম্যান্টেল স্তরের আয়তন বেশী। এই সÍর ১৮০০ মাইল বা ২৯০০ কি.মি গভীর।

(ক) লিথোসস্ফেয়ার বা শিলামন্ডল : এই স্তর পাথুরে স্তর। নিরেট ও শক্ত। লিথোসস্ফেয়ার-এর তাপমাত্রা ৩০০ থেকে ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বিদ্যমান। এই স্তরের সঞ্চারণের ফলে ভু-ত¦কে পরিবর্তণ সাধিত হয়। এই সঞ্চারণ দ্ইু ধরনের-ধীর (পাহাড়-পর্বতের উৎপত্তি, সাগরের বেসিন) এবং এবং দ্রত   ( আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যূৎপাত)। লিথোসস্ফেয়ার প্রায় ১২টি খন্ডাংশ (প্লেট) নিয়ে গঠিত এবং প্লেটগুলো স্থানোসস্ফেয়ার-এ ভেসে চলে।

(খ)
স্থানোসস্ফেয়ার বা দুর্বলস্তর: এই স্তরে পাথরগুলো মুলত প্রচšড তাপে গলিত বা অর্ধ-গলিত অব¯হায় থাকে। পাথরের কোন কাঠিন্য থাকে না।স্থানোসস্ফেয়ার-এর তাপমাত্রা ৪৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি।প্রচন্ড তাপ ও চাপের প্রভাবে পাথর এখানে গলিত বা অর্ধ-গলিত অবˉহায়   ( অনেকটা আলকাতরার ন্যায়)বিরাজ করে ।


আউটর কোর বা বহি:¯হ মূল: এই স্তরটি তরল এবং পুরুত্ব ২৩০০ কি.মি। ম্যান্টাল এবং ক্রাস্ট-এর তুলনায় এই স্তরের ঘনত্ব অনেক বেশী। ঘনত্ব ৯,৯০০ থেকে ১২,২০০ কেজি/প্রতি ঘন মিটার। এই আউটার কোরের আশি শতাংশই লোহা এবং বাকী বিশ শতাংশই নিকেল এবং হাল্কা উপাদানে গঠিত। আউটার কোরের বাইরের দিকে তাপমাত্রা ৪০৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং ভিতরের দিকে ( ইনার কোরের সন্নিকটে) এই স্তরের তাপমাত্রা ৫,৭৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস।

ইনার কোর বা অন্ত:মুল: এই স্তরটি নিরেট বা কঠিন। নিকেল এবং লোহা দ্বারা গঠিত। এই স্তরের ব্যাসার্ধ ১,২২০ কি.মি। ঘনত্ব ১২,৬০০-১৩,০০০ কি.মি/ঘন মিটার-যা থেকে বোঝা যায় এই স্তরে উল্লেখ্যযোগ্য পরিমানে ভারী ধাতু যেমন সোনা,প্লাটিনাম,পেলাডিয়াম,সিলভার এবং ট্রাংস্টেন আছে। এই স্তরের তাপমাত্রা প্রায় ৫,৪০০ ডিগী সেন্টিগ্রেড। 




প্লেট টেক্টটনিক তত্ত¦ এবং ভুমিকম্পের উৎপত্তি: পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে, পৃথিবীর ক্রাস্ট লিথোসস্ফেয়ার এবং আস্থানোসস্ফেয়ার নিয়ে গঠিত। লিথোসস্ফেয়ার আসলে ১২টি মুল খন্ত এবং বেশকিছু খন্ডাংশ নিয়ে গাঠত। এই খন্ডগুলো আস্থানোসস্ফেয়ার-এ সঞ্চারণশীল। এই সঞ্চারনের গতি বছওে ২-৩ সে.মি। এই সদা সঞ্চারণশীল খন্ড গুলোকে প্লেট বলা হয়। নিচের চিত্রে প্লেটগুলোর অব¯হার দেখানো হলো:



প্লেটগুলো ম্যান্টেলের গলিত ম্যাগমার উপর ভাসে। এই গলিত ম্যাগমায় পরিচলন ¯্রােত বা কনভেকশন কারেন্ট-এর জন্য প্লেটগুলো ধীরে ধীরে বিভিন্ন দিকে সঞ্চারিত হয়। কোর-এর তাপমাত্রার জন্য ম্যান্টেল উক্কপ্ত হয়। উত্তপ্ত শিলা ধীরে ধীরে ক্রাস্টের দিকে উঠতে থাকে এবং তাপ হারাতে থাকে। এই উত্তপ্ত শিলা যখন ক্রাস্টের কাছাকাছি আসে তখন তা উপরের শক্ত পাহুরে স্তর ভেদ করতে পারে না বিধায় একপাশে সরে আসে। ক্রাস্টের নিকটে আসার ফলে এই উক্কপ্ত শিলা আরো শীতল হয়ে পড়ে এবং ওজনে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে পুনরায় আউটার কোরের দিকে নামতে থাকে। আউটার কোরে যখন এই শীতল শিলা এসে পড়ে, তখন তা আউটার কোরের নিরেট নিকেল/লোহার স্তর ভেদ করতে পারে না ।  এ পর্যায়ে এই শীতল শিলা পুনরায় উত্তপ্ত হয় এবং উপরের ক্রোরের দিকে উঠতে থাকে। উক্কপ্তকরণ, উত্তোলন, শীতলীকরণ এবং ডুবে যাত্তয়া-এই চারটি প্রক্রিয়া ম্যাগমায় এক ধরনের ¯্রােতের উৎপত্তি করে, যা পরিচলন ¯্রােত বা কনভেক্শন কারেন্ট নামে পরিচিত।


পরিচলন ¯্রােত-এর কারনে প্লেটগুলো একটির সাথে আরেকটি পেটের সংর্ঘষ ঘটে। আবার একটি প্লেট অপর প্লেট থেকে দুরে সরে যায়। দুটি প্লেট যে সীমানায় সংর্ঘষ করে বা যেখান থেকে বিছিন্ন হয়, সেই সীমানাতেই ভুমিকম্প,আগ্নেয়গিরির অগ্নুঃপাত, পাহাড়-পর্বতের উৎপত্তি এবং মহাসাগরীয় ট্রেন্চ  বা খাদ সৃষ্টি হয়। প্লেট বাউন্ডারী বা সীমানা তিন রকমের:

১.কনভারজেন্ট বা অভিসারী সীমানা: যে সীমারেখা বরাবর দুটি প্লেট-এর সংর্ঘষ ঘটে। (১) যখন দুটি মহাদেশীয় প্লেট পরষ্পরের সাথে যে সীমারেখা বরাবর ধাক্কা খায়, সে সীমারেখা বরাবর ভু-ত্বকে ভাঁজ সৃষ্টি হয় এবং পর্বতমালা সৃষ্টি হয়। ভারতীয় প্লেট এবং এশিয়ান প্লেটের সংর্ঘষের ফলে ৫৫ মিলিয়ন বছর আগে হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি হয়। আবার যখন ওশানিক(মহাসাগরীয়)প্লেট মহাদেশীয়(কন্টিন্টোল)প্লেটের নীচে ঢুকে পড়ে,তখন সাবডাকশন জোন সৃষ্টি হয়।  মহাদেশীয় প্লেটটি উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং এক পর্যায়ে পর্বতমালা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে মহাসাগরীয় প্লেটটি গলতে থাকে যা আগ্নেয়গিরির অগ্যূৎপাত মাধ্যমে চারদিকে বিক্ষিপ্ত হয়। উদাহরণ- দক্ষিণ আফ্রিকার আ›্রজি পর্বতমালার কিছু পর্বত।

(২) দুটি মহাসাগরীয় ( ওশোনিক) প্লেট যখন ধাক্কা খায় তখন একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের নীচে ঢুকে পড়ে এবং গভীর খাদ বা ট্রেন্চ সৃষ্টি হয়। উক্কও প্রশান্তমহাসাগরে ম্যারিয়ানা ট্রেন্চটির ( পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম পয়েন্ট) উৎপত্তি হয়েছে এইভাবেই। অনেকসময় মহাসাগরীয় প্লেটের সংর্ঘষের ফলে সাগরের নীচে আগ্নেয়গিরি জন্ম হয় এবং লাভা জমে দ্বীপ সৃষ্টি হয় যেমন, জাপান।




ডাইভারজেন্ট বা প্রতিসারী সীমানা : যে সীমারেখায় দুটি প্লেট পরষ্পর থেকে বিচিছন্ন হয় তাকে ডাইভারজেন্ট বা প্রতিসারী সীমানা বলে। ডাইভারজেন্ট বাউন্ডারীকে গঠনমূলক সীমানাও বলা যায়। কারণ, ম্যান্টেল থেকে ম্যাগমা এসে ঠান্ডা হয়ে নতুন ক্রাষ্ট গঠন করে। (১) যখন দুটি ওশানিক বা মহাসাগরীয় প্লেট পরষ্পর থেকে বিছিন্ন হয় তখন সাগরপৃষ্ট প্রসারিত হয় এবং সাগরপৃষ্টে সুগভীর ফাটল দেখা দেয় । ম্যান্টেল থেকে ম্যাগমা এসে এই ফাটল ভরাট কওে এবং সাগরপৃষ্টে দীর্ঘ আগ্নেয়গিরি উৎপত্তি করে। ধীরে ধীরে এই ম্যাগমা শীতল হয়ে আগ্নেয়শিলার  নতুন ক্রাষ্ট গঠন করে। ক্রমাগত ম্যাগমার উধ্ধগতির ফলে ম্যাগমা স্তুপীকৃত আকার ধারন করে এবং মিড ওশানিক রিজ বা মধ্য মহাসাগরীয় শৈলশিরা গঠন করে। উদাহরণ-মিড আটলান্টিক রিজ যা আকটিক মহাসাগর থেকে আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। মিড আটলান্টিক রিজে সাগরপৃষ্টের সম্প্রসারণের ( সি-ফেøার স্প্রেডিং) হার বছরে প্রায় ২.৫ সে.মি।

(২) যখন দুটি মহাদেশীয় প্লেট পরষ্পর থেকে সরে যায় তখন ভুপৃষ্টে ফাটল দেখা দেয়। বিছিন্ন হওয়ার ফলে ক্রাষ্ট ক্রমান্বয়ে প্রসারিত এবং পাতলা হয় এবং বিছিন্ন হওয়ার স্হানে এবং এর আশেপাশে উপত্যকা এবং আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়। রিফ্ট বা ফাটল সৃষ্টিকালে ঝর্ণা এবং নদী নিচু উপত্যকা ভরে ফেলে দীর্ঘ লেক বা হ্রদ সুষ্টি করে। অনেকসময় বিছিন্ন হওয়ার স্হানে ভু-ত্বক এতই পাতলা এবং প্রসারিত হয় যে মুল প্লেট থেকে বিছিন্ন হয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটি প্লেট গঠিত হয়। যখন এরকম ঘটে তখন রিফট জোনে কোন একটি সাগর সরে এসে সম্পূর্ণ একটি নতুন সাগর বা ওশান বেসিন গঠিত করে। উদাহরন-পূর্ব আফ্রিকা-যেখানে আরব প্লেট আফ্রিকান প্লেট থেকে সরে যাচ্ছে। এর ফলে সৌদি আরব আফ্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে এবং লোহিত সাগরের উৎপত্তি হয়েছে।

ট্রান্সফর্ম বা রুপান্তর সীমানা : যেখানে দুটি প্লেট পরষ্পরকে সমান্তরালে অতিক্রম করে। দুটি প্লেটের অতিক্রান্তের সময় ক্রাষ্টে ফাটল দেখা দেয় এবং এই ফাটলকে ফল্ট বা চ্যুাতি বলে। এই ট্রান্সফরম বাউন্ডারীতেই ভুমিকম্প উৎপন্ন হয়। ট্রান্সফরম বাউন্ডারীতে প্লেটের প্রান্ত খাঁজ কাটা বিধায় এক প্লেট  আরেক প্লেটকে অতিক্রান্তের সময় আটকে যায় এবং সরতে পারে না। ফল্ট লাইন বরাবর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হতে থাকে। এই চাপ যখন হঠাৎই অবমুক্ত হয়, তখন প্লেট দুটি নতুন কোন অব¯হানের সরে যায়। প্লেটের হঠাৎই এই নড়াচড়ার ফলস্বরুপ ভুমিকম্পের উৎপত্তি হয়।

বেশীরভাগ ট্রান্সফর্ম সীমানা তৈরী হয় সাগরপৃষ্টে । খুবই কমসংখ্যক দেখা যায় ভুপৃষ্টে যেমন,কার্লিফোনিয়ার সান আন্দ্রিজ ফল্ট জোন। এই ফল্ট প্রায় ১,৩০০ কি.মি লম্বা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট এবং নর্থ আমেরিকান প্লেটের সংর্ঘষের ফলে সান আন্দ্রিজ ফল্টের উৎপত্তি এবং গত ১০ মিলিয়ন বছর এই প্লেট দুটি বছরে গড়ে ৫ সে.মি করে পরষ্পরকে অতিক্রম করছে।



ফল্ট বা চ্যুতি: অধিকাংশ ভুমিকম্প ফল্ট জোনে উৎপন্ন হয়। ফল্ট হলো ভু-ত্বক বা লিথো¯েফায়ারেরশিলাতে ফাটল বিশেষ। ফল্টে শিলার একটি অংশ(ব্লক) আরেকটি অংশ থেকে উপরে,নীচে বা সমান্তরাল বরাবর সরে যায় এবং যে তল বরাবর শিলার দুটি ব্লক বিভিন্ন দিকে( উপরে, নীচে বা সমান্তরাল) সরে যায়, তাকে ফল্ট প্লেইন বলে।

স্টাইক-সিøপ ফল্ট: এ ধরনের ফল্টে দুটি ব্লক পরষ্পর থেকে সমারন্তরালে সরে যায় এবং ফল্ট প্লেন প্রায় উলম্ব বা খাড়া থাকে।


নরমাল বা সাধারণ ফল্ট: এ ধরনের ফল্টে একটি ব্লক আরেকটি ব্লক থেকে প্রায় উলম্ব তল (ফল্ট প্লেন) বরাবর নীচের দিকে সরে যায় এবং অন্য বল্কটি উপরে উঠে আসে। নীচের দিকে সরে যাওয়া ব্লকটিকে হ্যাংগিং ওয়াল বা ঝুলন্ত ওয়াল বলে এবং উপরের দিকে উঠে যাওয়া বল্কটিকে ফুটওয়াল বলে। মাঝের চিত্রে, গাছ সংবলিত ব্লকটি নীচের দিকে সরে এসেছে এবং অপর বল্কটি উপরের দিকে উঠে এসেছে। বিপরীতমুখী বা টেনশনাল শক্তির কারনে এই ধরনের ফল্টের উৎপত্তি হয়। নরমাল ফল্টকে নরমাল সিøপ ফল্ট,টেনশনাল ফল্ট এবং গ্যাভিটি ফল্টও বলে। উদাহরণ:বেসির ও রেন্জ ফল্ট।


বিপরীত বা রির্ভাস ফল্ট: এই ফল্টটি নরমাল ফল্টের বিপরীত। এক্ষেত্রে হ্যাংগিং ওয়ালটি উপরের দিকে সরে যায় এবং ফুটওয়ালটি নীচের দিকে সরে আসে। সংকোচনশীল বলের প্রভাবে এই ধরনের ফল্টের উৎপক্কি হয়। এ ধরনের ফল্টকে রির্ভাস সিøপ ফল্ট বা সংকোচনশীল ফল্ট বলে। উদাহরণ: রকি ও হিমালয় পর্বতমালা।


সুনামী

সুনামী হলো বিশেষ ধরনের সামুদ্রিক ঢেউ-এর সমষ্টি ।‘সুনামী’ জাপানী শব্দ । অর্থ ‘হারবার ওয়েভ’ বা ‘তীরের ঢেউ’। সাগরের নীচে রিক্টারস্কেলে ৮ অথবা তার উপরের মাত্রার ভুমিকম্পের ফলে সুনামীর সৃষ্টি হয়।অনেক সময় সাগরের নীচে ভুমিধস কিংবা আগেয়œগিরির অগ্ন্যৎপাতের ফলেও সুনামীর সৃষ্টি হতে পারে। ঢেউ চক্রাকারে চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়ে। গভীর সাগরে এই ঢেউ-এর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। ঢেউ-এর চুড়া মাত্র কয়েক ফুট লম্বা হতে পারে। এই ঢেউ যখন তীরের দিকে অগভীর পানির দিকে অগ্রসর হতে থাকে,তখন ঢেউ-এর উচ্চতা হঠাৎ করেই বৃদ্ধি( ১০০ মিটার পর্যন্ত) পায় এবং বিধ্বংসী শক্তি নিয়ে তীরবর্তী এলাকায় আঘাত হানে। 

সুনামী সর্ম্পকে কিছু তথ্য নিচে দেওয়া হলো:

১.    সুনামীর  উচ্চতা ১০০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে।
২.    প্রায় ৮০% সুনামী প্রশান্ত মহাসাগরের ‘রিং অব ফায়ার’ বা আগ্নেয়বলয় এলাকায় সৃষ্টি হয়। ‘রিং অব ফায়ার’ হলো প্রশান্ত মহাসাগরের প্রান্ত ঘেষে আগ্নেয়গিরির বলয়।
৩.     এখন পর্যন্ত ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারত মহাসাগরে ভুমিকম্পের ফলে যে সুনামী হয়েছিল, সেটিই সবচেয়ে শক্তিশালী ভুমিকম্প। ভারত মহাসাগরে৯.০ মাত্রার এই ভুমিকম্পে ১৪টি দেশের ২১৬০০০ জন অধিবাসী নিগত হয়।
৪.    গভীর সাগরে সুনামী ঘন্টায় ৬০০ মাইল( ৯৬৫ কি.মি/ঘন্টা,৫২১ নট) পথ অতিক্রম করতে পারে।
৫.    সুনামী তীরের অগভীর পানিতে এসে ধীরগতিসম্পন্ন ( ৩০ থেকে ৪০ মা¦ইল/ঘন্টা, ২৬-৩৫ নট) হয়ে পড়ে কিন্তুু,উচ্চতায় বৃদ্ধি পায়।
৬.    তীরবর্তী এলাকায় খেঁজুর জাতীয় গাছ লাগিয়ে সুনামী প্রতিরোধ বেষ্টনী তৈরী করা যায়।



ইতিহাসে উল্লেখ্যযোগ্য সুনামী

১.    ১ নভেম্বর, ১৭৫৫: ভুমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সুনামীতে পর্তুগালের লিসবনে প্রায় ৬০,০০০ অধিবাসী নিহত হয় ।

২.    ২৭ আগষ্ট, ১৮৮৩: ক্রাকাতুয়া আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুপাতে ফলে সৃষ্ট সুনামীতে ইন্দোনেশিয়ার জাভা ও সুমাত্রা দ্বীপে প্রায় ৩৬০০০ অধিবাসী নিহত হয়।

৩.    ১৫ জুন,১৮৯৬: ৮.৫ মাত্রার ভুমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সুনামীতে জাপানের সানরিকু প্রদেশে প্রায় ২৮,০০০ অধিবাসী নিহত হয়।

৪.    ২৮ ডিসেম্বর,১৯০৮:

মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৮

সিস্মোলজি বা ভূ-কম্পণ বিদ্যা

ভূমিকম্পের ফলে যে অকল্পণীয় শক্তি নির্গত হয় তা ভূ-পৃষ্ঠে এবং ভূ-অভ্যন্তরে কম্পণ হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই কম্পণকে ভূ-কম্পনীয় তরংগ বলা হয়। ভু-অভ্যন্তরে এবং ভূ-পৃষ্ঠের এই ভূ-কম্পণীয় তরংগের স্বরুপ,প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব কিরুপ,তা জানার জন্য যে নিয়মমাফিক জ্ঞানচর্চা করা হয় তাকে সিসমোলজি বলে।

ভূমিকম্পের কেন্দ্র: ভুমিকম্পের উৎস বা উৎপত্তিস্থলকে ফোকাস বা কেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্র প্রকৃতপক্ষে ভূ-অভ্যন্তরের যে স্থানে (বিশেষ করে ফল্ট বা চ্যুতি বরাবর) দীর্ঘ সময়ব্যাপী সঞ্চিত শক্তির হঠাৎ অবমুক্তির ফলে ভূ-কম্পনীয় তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, সেই স্থানকে নির্দেশ করে।

ভূমিকম্পের এপিসেন্টার বা উপকেন্দ্র: ভূপৃর ফোকাস বা কেন্দ্রের ঠিক উপরে উলম্ব বরাবর যে স্থা নির্দেশ করে, তাকে ভূমিকম্পের এপিসেন্টার বা উপকেন্দ্র বলে । 

ভূমিকম্পের কেন্দ্র বা ফোকাসে যে ভু-কম্পনীয় তরঙ্গ উৎপন্ন হয়,তা প্রকারভেদে নিদিষ্ট করা যায়।

১.ভু-অভ্যন্তরীয় মূল তরঙ্গ বা বডি ওয়েভ : এই তরঙ্গ কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন হয়ে ভু-অভ্যন্তরে চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দুই ধরনের ভু-অভ্যন্তরীয় মুল-তরঙ্গ আছে-

ক. পি-ওয়েভ বা প্রাথমিক তরঙ্গ: পি-ওয়েভ অনেকটা শব্দ তরঙ্গের মতো। পি-ওয়েভ যখন ভু-অভ্যন্তরে শিলারাশির মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে তখন তা শিলারাশিকে সংকুচিত করেএবং সংকোচনের পরে তাপ্রসারিত করে অথাৎ পি-ওয়েভ বস্তুর (শিলা)সংকোচন-প্রসারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভু-অভ্যন্তরে ভ্রমণ করে। সকল ভূ-কম্পনীয় তরঙ্গের মধ্যে পি-ওয়েভের গতিবেগ সর্বোচ্চ ফলে সকল সিস্মোগ্রাফ যন্ত্রে সর্বপ্রথম ধরা পড়ে।

পি-ওয়েভের বৈশিষ্ট্যাবলী :
১. গতি অত্যন্ত দ্রত (৪-৭ কি.মি/সে.)।
২. তরল এবং গ্যাসীয় মাধ্যমে প্রবাহিত হয়।
৩. সিস্মোগ্রাফে প্রথম ধরা পড়ে।

খ. এস-ওয়েভ বা সেকেন্ডারী তরঙ্গ:এস-ওয়েভ বা সেকেন্ডারী তরঙ্গ-এর গতিবেগ নির্ভর করে বস্তুরকাঠিণ্য এবং ঘনত্বের উপর।এস-ওয়েভ বস্তুুর আকার-আকৃতি পরিবর্তনের মাধ্যমে ভ্রমণ করে থাকে। আকৃতি পরিবর্তন রোধ করা সক্ষমতাকে বস্তুর কাঠিন্য বলা হয়। পানির কোন কাঠিন্য নেই ফলে, পানিতে এস-ওয়েভের কোন গতিবেগ নেই। পি-ওয়েভের চেয়ে এস-ওয়েভের গতিবেগ কম ফলে, পি-ওয়েভের পরে সিসমোগ্রাফে এস-ওয়েভ শনাক্ত হয়।
উদাহরণ: একখন্ড দঁড়িনিন। দঁড়িটির এক মাথা একটি দন্ডের সাথে বেঁধে নিন। এখন দঁড়ির আরেক প্রান্ত ধরে ঝাঁকি দিন। দঁড়িতে সেকেন্ডারী তরঙ্গের সৃষ্টি হবে (তরঙ্গ হাতের প্রান্ত থেকে উৎপন্ন হয়ে ক্রমান্বয়ে দন্ডের দিকে অগ্রসর হবে)।
এস-ওয়েভের বৈশিষ্ট্যাবলী:
১. গতি ধীর (২-৫ কি.মি/সেকেন্ড ।
২. তরল এবং গ্যাসীয় মাধ্যমে প্রবাহিত হতে পারে না।
৩. সিস্মোগ্রাফে পি-ওয়েভের পর এস-ওয়েভ ধরা পড়ে।


গ. ভূ-পৃষঠীয় তরঙ্গ বা সারফেস ওয়েভ : ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র বা এপিসেন্টার থেকে ভূ-পৃষ্ঠে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে,অনেকটা শান্ত পুকুরে ঠিল ছুঁড়লে যে রকম তরঙ্গ সৃষ্টি হয় সে রকম। এই তরঙ্গ-এর গতি সবচেয়ে ধীর  হলেও ভূ-ত্বকের নীচের শিলাখন্ডকে গড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে যা পৃথিবীর পৃষ্ঠে মানুষের নির্মিত স্থাপনার জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর।

সিস্মোমিটার :

ভূ-পৃষ্ঠে এবং ভূ-অভ্যন্তরে কম্পণের মধ্য দিয়ে ভূ-কম্পনীয় তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে । সিস্মোমিটার একটি বিশেষ ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্র,যার সাহায্যে কম্পণ রের্কড করা হয়। যে মাধ্যমে(যেমন কাগজ-বর্তমানে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করা হয়)এই কম্পণ গ্রাফ হিসাবে রের্কড করা হয়,তাকে সিসমোগ্রাম বলে। একটি সরল সিস্মোমিটারে একটি ভারী গোলাকার ধাতবপিন্ড স্প্রিং বা তার দিয়ে ঝুঁলিয়ে দেওয়া হয়। এই ধাতবপিন্ডের নিচে একটি কলম লাগানো থাকে। কলমের নীচে ঘূর্ণায়মান কাগজ থাকে। কলমটি কাগজকে স্পর্শ করে থাকে। সিস্মোমিটারটিকে ভূ-পৃষ্ঠে পাটাতন সহ বসানো হয়, যাতে ভূমিকম্পের ফলে পাটাতনটিও কাঁপতে পারে। কিন্তুু ভারী ওজনের সাথে সংযুক্ত কলমটি স্থর থাকে। ভূমিকম্পের সময় কাগজসহ ঘূর্ণায়মাণ সিলিন্ডারটি কাঁপতে থাকবে (ভূ-পৃষ্ঠে বেড রকে উপর বসানো থাকে)কিন্ত ভারী ওজনের জন্য কলমটি স্থির থেকে কাগজের উপর গ্রাফ (আঁকা-বাঁকা রেখা) এঁকে যায়।


সিস্মোগ্রামে সময়ের বিপরীতে কম্পণ রের্কড করা হয়। সিস্মোগ্রাফে নিদিষ্ট বিরতীতে সময় চিহিত করা থাকে। যাতে প্রথম পি-ওয়েভ এবং প্রথম এস-ওয়েভের শনাক্তকাল বোঝা যায়। 


ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র বা এপিসেন্টার অনুসন্ধান:

ভুমিকম্পের এপিসেন্টার বের করার জন্য এপিসেন্টার থেকে বিভিন্ন দুরত্বে অবস্থিত কমপক্ষে তিনটি সিস্মোগ্রাফিক ষ্টেশনের সিস্মোগ্রাফ রের্কডের প্রয়োজন হয়। আর যে প্রয়োজনীয় তথ্য জানা দরকার সেটি হলো পি-ওয়েভ এবং এস-ওয়েভের ভূ-অভ্যন্তরে ভ্রমণকাল এবং কত সময়ে এই তরংগ দুইটি কোন সিস্মোগ্রাফিক ষ্টেশনে শনাক্ত হয়েছে। গত ৮০ বছরের অধিক সময়কাল ধরে এই ভ্রমন সময়কাল কার্ভ বা তথ্য সংগৃহীত হচ্ছে।

প্রত্যেক ষ্টেশনে সিস্মোগ্রাফে সাধারণত এস-পি ইন্টারভ্যালনির্ণয় করা হয় (প্রথম এস-ওয়েভের শনাক্তকাল এবং প্রথম পি-ওয়েভের শনাক্তকালের ব্যবধান)। ভ্রমণকাল কার্ভে, স্টেশন থেকে এপিসেন্টারের  দুরত্ব যত বাড়বে এস-পি ইন্টারভ্যালও তত বাড়বে।

এস-পি ইন্টারভ্যালের সাহায্যে কোন একটি সিস্মোগ্রাফিক ষ্টেশন থেকে এপিসেন্টারের দুরত্ব বের করা যায়। এরুপ একটি এপিসেন্টার ও ষ্টেশনের মধ্যবর্তী দুরত্বকে ব্যাসার্ধ ধরে মানচিত্রে একটি বৃত্ত আঁকা হয়। মানচিত্রে এরুপ তিনটি বৃত্ত যে বিন্দুতে পরষ্পরকে ছেদ করে, সেই বিন্দুটি ভুমিকম্পের এপিসেন্টার বা উপকেন্দ্র নির্দেশ করে।

মনে করি, ভু-পৃষ্টে তিনটি ষ্টেশন( ১,২ ও ৩) আছে এবং ভুমিকম্পের পর এই তিনটি ষ্টেশনে এস-ওয়েভ এবং পি-ওয়েভের শনাক্তকরণ সময় বের করা হয়েছে নিম্নরুপ:

ষ্টেশন:১
 এস-ওয়েভ ও পি-ওয়েভের শনাক্তকরণ সময়ের ব্যবধান=৪ মি.০ সে.।
 এপিসেন্টার থেকে ষ্টেশন-১-এর দুরত্ব=২,৮০০ কি.মি।

ষ্টেশন:২
এস-ওয়েভ ও পি-ওয়েভের শনাক্তকরণ সময়ের ব্যবধান=৫ মি.৪০ সে.।
 এপিসেন্টার থেকে ষ্টেশন-২-এর দুরত্ব=৪,০০০ কি.মি।

ষ্টেশন:৩
 এস-ওয়েভ ও পি-ওয়েভের শনাক্তকরণ সময়ের ব্যবধান=৩ মি.০ সে.।
 এপিসেন্টার থেকে ষ্টেশন-৩-এর দুরত্ব=১,৮০০ কি.মি।

৩ টি ষ্টেশন থেকে এপিসেন্টারের দুরত্ব বের করা হয়েছে। কিন্তু আমরা এখনো জানি না এপিসেন্টারটির আসল অবস্থান। কারণ,  একটি ষ্টেশনকে কেন্দ্র ধরে এপিসেন্টারের দৈর্ঘকে ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অংকন করা হলে, এপিসেন্টার ঠিক কোন দিকে (এটি পূর্ব,পশ্চিম,উত্তর এবং দক্ষিণ) সেটি বের করা যায় না। কারণ বৃত্তের ব্যার্সার্ধ সবদিকেই সমান। এই সমস্যা সমাধান করার জন্য ৩ টি ষ্টেশনকে বৃত্তের কেন্দ্র ধরে এপিসেন্টারের দুরত্বকে ব্যাসার্ধ ধরে তিনটি বৃত্ত আঁকলে, বৃত্ত তিনটি যে বিন্দুতে ছেদ করে বা স্পর্শ করে যায়,ভু-পৃষ্টে সেই বিন্দুটিই ভুমিকম্পের এপিসেন্টার বা উপকেন্দ্র। ভালভাবে বোঝার জন্য নিচের চিত্র  লক্ষ্য করুন:



ভূমিকম্পের মাত্রা


যখন পৃথিবীর কোন স্থানে প্রয়ংকারী ভুমিকম্প হয়, তখন সবাই যেটা জানতে চায়, সেটা হলো-ভুমিকম্পের উৎপত্তিস্থ এবং এর প্রচন্ডতা বা মাত্রা । দুই ধরনের স্কেল আছে ভুমিকম্পের মাত্রা এবং তীব্রতা পরিমাপের জন্য।

রিক্টারস্কেল

ভুমিকম্পের ব্যাপকতা বা ম্যাগনিটিউট মাপার জন্য রিক্টার স্কেল ব্যবহার করা হয় ।  এক কথায় ভুমিকম্পের ম্যাগনিটিউট বা মাত্রা হলো দীর্ঘতম ভু-কম্পন তরঙের আকার বা প্রশস্তরতার উপর ভিত্তি ভুমিকম্পের সময় নির্গত শক্তির পরিমাপ করা। রিক্টার স্কেল একটি লগ-স্কেল। এই স্কেলে ০ থেকে ১০ পর্যন্ত মাত্রা পরিমাপ করা যায়।  রিক্টার স্কেলে একটি মাত্রা সাধারণত পূর্ববর্তী মাত্রা অপেক্ষা ১০ গুন বেশী । উদাহরণস্বরুপ, রিক্টারস্কেলে ৪.০ মাত্রাটি ৩.০ মাত্রা অপেক্ষা ১০ গুন বেশী এবং  ২.০ মাত্রা অপেক্ষা ১০০ গুন বেশী। নীচের সারণীতে পৃথিবীতে কোন মাত্রার ভুমিকম্প কতসময় পরপর ঘটে  তা দেখা যাক।



সংশোধিত মার্কাল্লি স্কেল
ভু-কম্পন তরঙের আকার-এর উপর ভিত্তি করে ভুমিকম্পের শক্তিমাত্রা আসলে সাধারণ জনগনের তেমন উপকারেআসে না। রিক্টারস্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা থেকে প্রকৃতপক্ষে ভুমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি সর্ম্পকে সঠিক ধারণা করা যায় না। রিক্টারস্কেলের এই অসুবিধার জন্য একটি বিকল্প স্কেল তৈরী করা হয়, যার সাহায্যে ভুমিকম্পের ইনটেনসিটি বা তীব্রতা পরিমাপ করা হয়।  ভুমিকম্পের তীব্রতা হলো বিশাল এলাকা  জুড়ে ভুমিকম্পের ফলে মানুষ্যনির্মিত ˉহাপনার ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়ন। সাধারণত ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ননার ভিত্তিতে মার্কাল্লি স্কেলে তীব্রতা পরিমাপ করা হয়।
নিচের সারণীতে উল্লেখ্য ইনটেনসিটি এবং রিক্টারস্কেলের মাত্রা  এপিসেন্টার এবং এর আশেপাশে এলাকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।




মোমেন্ট ম্যাগনিটিউট স্কেল

ভূমিকম্পের সময় কি পরিমান শক্তি নির্গত নির্গত হয়, তার উপর ভিত্তিকরে মোমেন্ট ম্যাগনিটিউট স্কেল তৈরী করা হয়েছে। মোমেন্ট বলতে বোঝা যায়, একটি ফল্ট বা চ্যূতি কি পরিমান সরে গেছে এবং এই সরে যাওয়ার জন্য কি পরিমান শক্তির প্রয়োগ হয়েছে।

দুভার্গ্যবশত, বহুল প্রচলিত রিক্টারস্কেলে  অতি বড়মাত্রার ভূমিকম্পের প্রায় সঠিক পরিমাপ সম্ভব নয় আর অপরদিকে মোমেন্ট ম্যাগনিটিউট স্কেল বিভিন্ন মাত্রার ( ছোট থেকে  অতি বড় মাত্রার) ভূমিকম্পের পরিমাপ সম্ভব। রিক্টারস্কেল  এবং মোমেন্ট ম্যাগনিটিউট স্কেল-এ  ছোট থেকে বড় মাত্রার পরিমাপ প্রায় একই কিন্তু, বিশাল এলাকাজুড়ে অতি বড় মাত্রার ভূমিকম্পের প্রায় সঠিক পরিমাপের জন্য মোমেন্ট ম্যাগনিটিউট স্কেল আর্দশ এবং বিশ্বব্যাপী সিসমোলজিষ্টদের কাছে আদরণীয়।

সূত্র: ইন্টারনেট , কপিরাইট : শুভ সালাতিন