ভূমিকম্পের ফলে যে অকল্পণীয় শক্তি নির্গত হয় তা ভূ-পৃষ্ঠে এবং ভূ-অভ্যন্তরে কম্পণ হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই কম্পণকে ভূ-কম্পনীয় তরংগ বলা হয়। ভু-অভ্যন্তরে এবং ভূ-পৃষ্ঠের এই ভূ-কম্পণীয় তরংগের স্বরুপ,প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব কিরুপ,তা জানার জন্য যে নিয়মমাফিক জ্ঞানচর্চা করা হয় তাকে সিসমোলজি বলে।
ভূমিকম্পের কেন্দ্র: ভুমিকম্পের উৎস বা উৎপত্তিস্থলকে ফোকাস বা কেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্র প্রকৃতপক্ষে ভূ-অভ্যন্তরের যে স্থানে (বিশেষ করে ফল্ট বা চ্যুতি বরাবর) দীর্ঘ সময়ব্যাপী সঞ্চিত শক্তির হঠাৎ অবমুক্তির ফলে ভূ-কম্পনীয় তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, সেই স্থানকে নির্দেশ করে।
ভূমিকম্পের এপিসেন্টার বা উপকেন্দ্র: ভূপৃর ফোকাস বা কেন্দ্রের ঠিক উপরে উলম্ব বরাবর যে স্থান নির্দেশ করে, তাকে ভূমিকম্পের এপিসেন্টার বা উপকেন্দ্র বলে ।
ভূমিকম্পের কেন্দ্র: ভুমিকম্পের উৎস বা উৎপত্তিস্থলকে ফোকাস বা কেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্র প্রকৃতপক্ষে ভূ-অভ্যন্তরের যে স্থানে (বিশেষ করে ফল্ট বা চ্যুতি বরাবর) দীর্ঘ সময়ব্যাপী সঞ্চিত শক্তির হঠাৎ অবমুক্তির ফলে ভূ-কম্পনীয় তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, সেই স্থানকে নির্দেশ করে।
ভূমিকম্পের এপিসেন্টার বা উপকেন্দ্র: ভূপৃর ফোকাস বা কেন্দ্রের ঠিক উপরে উলম্ব বরাবর যে স্থান নির্দেশ করে, তাকে ভূমিকম্পের এপিসেন্টার বা উপকেন্দ্র বলে ।
ভূমিকম্পের কেন্দ্র বা ফোকাসে যে ভু-কম্পনীয় তরঙ্গ উৎপন্ন হয়,তা প্রকারভেদে নিদিষ্ট করা যায়।
১.ভু-অভ্যন্তরীয় মূল তরঙ্গ বা বডি ওয়েভ : এই তরঙ্গ কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন হয়ে ভু-অভ্যন্তরে চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দুই ধরনের ভু-অভ্যন্তরীয় মুল-তরঙ্গ আছে-
ক. পি-ওয়েভ বা প্রাথমিক তরঙ্গ: পি-ওয়েভ অনেকটা শব্দ তরঙ্গের মতো। পি-ওয়েভ যখন ভু-অভ্যন্তরে শিলারাশির মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে তখন তা শিলারাশিকে সংকুচিত করেএবং সংকোচনের পরে তাপ্রসারিত করে অথাৎ পি-ওয়েভ বস্তুর (শিলা)সংকোচন-প্রসারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভু-অভ্যন্তরে ভ্রমণ করে। সকল ভূ-কম্পনীয় তরঙ্গের মধ্যে পি-ওয়েভের গতিবেগ সর্বোচ্চ ফলে সকল সিস্মোগ্রাফ যন্ত্রে সর্বপ্রথম ধরা পড়ে।
পি-ওয়েভের বৈশিষ্ট্যাবলী :
১. গতি অত্যন্ত দ্রত (৪-৭ কি.মি/সে.)।
২. তরল এবং গ্যাসীয় মাধ্যমে প্রবাহিত হয়।
৩. সিস্মোগ্রাফে প্রথম ধরা পড়ে।
খ. এস-ওয়েভ বা সেকেন্ডারী তরঙ্গ:এস-ওয়েভ বা সেকেন্ডারী তরঙ্গ-এর গতিবেগ নির্ভর করে বস্তুরকাঠিণ্য এবং ঘনত্বের উপর।এস-ওয়েভ বস্তুুর আকার-আকৃতি পরিবর্তনের মাধ্যমে ভ্রমণ করে থাকে। আকৃতি পরিবর্তন রোধ করা সক্ষমতাকে বস্তুর কাঠিন্য বলা হয়। পানির কোন কাঠিন্য নেই ফলে, পানিতে এস-ওয়েভের কোন গতিবেগ নেই। পি-ওয়েভের চেয়ে এস-ওয়েভের গতিবেগ কম ফলে, পি-ওয়েভের পরে সিসমোগ্রাফে এস-ওয়েভ শনাক্ত হয়।
উদাহরণ: একখন্ড দঁড়িনিন। দঁড়িটির এক মাথা একটি দন্ডের সাথে বেঁধে নিন। এখন দঁড়ির আরেক প্রান্ত ধরে ঝাঁকি দিন। দঁড়িতে সেকেন্ডারী তরঙ্গের সৃষ্টি হবে (তরঙ্গ হাতের প্রান্ত থেকে উৎপন্ন হয়ে ক্রমান্বয়ে দন্ডের দিকে অগ্রসর হবে)।
এস-ওয়েভের বৈশিষ্ট্যাবলী:১. গতি ধীর (২-৫ কি.মি/সেকেন্ড ।
২. তরল এবং গ্যাসীয় মাধ্যমে প্রবাহিত হতে পারে না।
৩. সিস্মোগ্রাফে পি-ওয়েভের পর এস-ওয়েভ ধরা পড়ে।
গ. ভূ-পৃষঠীয় তরঙ্গ বা সারফেস ওয়েভ : ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র বা এপিসেন্টার থেকে ভূ-পৃষ্ঠের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে,অনেকটা শান্ত পুকুরে ঠিল ছুঁড়লে যে রকম তরঙ্গ সৃষ্টি হয় সে রকম। এই তরঙ্গ-এর গতি সবচেয়ে ধীর হলেও ভূ-ত্বকের নীচের শিলাখন্ডকে গড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে যা পৃথিবীর পৃষ্ঠে মানুষের নির্মিত স্থাপনার জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর।
সিস্মোমিটার :
ভূ-পৃষ্ঠে এবং ভূ-অভ্যন্তরে কম্পণের মধ্য দিয়ে ভূ-কম্পনীয় তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে । সিস্মোমিটার একটি বিশেষ ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্র,যার সাহায্যে কম্পণ রের্কড করা হয়। যে মাধ্যমে(যেমন কাগজ-বর্তমানে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করা হয়)এই কম্পণ গ্রাফ হিসাবে রের্কড করা হয়,তাকে সিসমোগ্রাম বলে। একটি সরল সিস্মোমিটারে একটি ভারী গোলাকার ধাতবপিন্ড স্প্রিং বা তার দিয়ে ঝুঁলিয়ে দেওয়া হয়। এই ধাতবপিন্ডের নিচে একটি কলম লাগানো থাকে। কলমের নীচে ঘূর্ণায়মান কাগজ থাকে। কলমটি কাগজকে স্পর্শ করে থাকে। সিস্মোমিটারটিকে ভূ-পৃষ্ঠে পাটাতন সহ বসানো হয়, যাতে ভূমিকম্পের ফলে পাটাতনটিও কাঁপতে পারে। কিন্তুু ভারী ওজনের সাথে সংযুক্ত কলমটি স্থর থাকে। ভূমিকম্পের সময় কাগজসহ ঘূর্ণায়মাণ সিলিন্ডারটি কাঁপতে থাকবে (ভূ-পৃষ্ঠে বেড রকে উপর বসানো থাকে)কিন্ত ভারী ওজনের জন্য কলমটি স্থির থেকে কাগজের উপর গ্রাফ (আঁকা-বাঁকা রেখা) এঁকে যায়।
সিস্মোগ্রামে সময়ের বিপরীতে কম্পণ রের্কড করা হয়। সিস্মোগ্রাফে নিদিষ্ট বিরতীতে সময় চিহিত করা থাকে। যাতে প্রথম পি-ওয়েভ এবং প্রথম এস-ওয়েভের শনাক্তকাল বোঝা যায়।
ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র বা এপিসেন্টার অনুসন্ধান:
ভুমিকম্পের এপিসেন্টার বের করার জন্য এপিসেন্টার থেকে বিভিন্ন দুরত্বে অবস্থিত কমপক্ষে তিনটি সিস্মোগ্রাফিক ষ্টেশনের সিস্মোগ্রাফ রের্কডের প্রয়োজন হয়। আর যে প্রয়োজনীয় তথ্য জানা দরকার সেটি হলো পি-ওয়েভ এবং এস-ওয়েভের ভূ-অভ্যন্তরে ভ্রমণকাল এবং কত সময়ে এই তরংগ দুইটি কোন সিস্মোগ্রাফিক ষ্টেশনে শনাক্ত হয়েছে। গত ৮০ বছরের অধিক সময়কাল ধরে এই ভ্রমন সময়কাল কার্ভ বা তথ্য সংগৃহীত হচ্ছে।
প্রত্যেক ষ্টেশনে সিস্মোগ্রাফে সাধারণত এস-পি ইন্টারভ্যালনির্ণয় করা হয় (প্রথম এস-ওয়েভের শনাক্তকাল এবং প্রথম পি-ওয়েভের শনাক্তকালের ব্যবধান)। ভ্রমণকাল কার্ভে, স্টেশন থেকে এপিসেন্টারের দুরত্ব যত বাড়বে এস-পি ইন্টারভ্যালও তত বাড়বে।
এস-পি ইন্টারভ্যালের সাহায্যে কোন একটি সিস্মোগ্রাফিক ষ্টেশন থেকে এপিসেন্টারের দুরত্ব বের করা যায়। এরুপ একটি এপিসেন্টার ও ষ্টেশনের মধ্যবর্তী দুরত্বকে ব্যাসার্ধ ধরে মানচিত্রে একটি বৃত্ত আঁকা হয়। মানচিত্রে এরুপ তিনটি বৃত্ত যে বিন্দুতে পরষ্পরকে ছেদ করে, সেই বিন্দুটি ভুমিকম্পের এপিসেন্টার বা উপকেন্দ্র নির্দেশ করে।
মনে করি, ভু-পৃষ্টে তিনটি ষ্টেশন( ১,২ ও ৩) আছে এবং ভুমিকম্পের পর এই তিনটি ষ্টেশনে এস-ওয়েভ এবং পি-ওয়েভের শনাক্তকরণ সময় বের করা হয়েছে নিম্নরুপ:
ষ্টেশন:১
এস-ওয়েভ ও পি-ওয়েভের শনাক্তকরণ সময়ের ব্যবধান=৪ মি.০ সে.।
এপিসেন্টার থেকে ষ্টেশন-১-এর দুরত্ব=২,৮০০ কি.মি।
ষ্টেশন:২
এস-ওয়েভ ও পি-ওয়েভের শনাক্তকরণ সময়ের ব্যবধান=৫ মি.৪০ সে.।
এপিসেন্টার থেকে ষ্টেশন-২-এর দুরত্ব=৪,০০০ কি.মি।
ষ্টেশন:৩
এস-ওয়েভ ও পি-ওয়েভের শনাক্তকরণ সময়ের ব্যবধান=৩ মি.০ সে.।
এপিসেন্টার থেকে ষ্টেশন-৩-এর দুরত্ব=১,৮০০ কি.মি।
৩ টি ষ্টেশন থেকে এপিসেন্টারের দুরত্ব বের করা হয়েছে। কিন্তু আমরা এখনো জানি না এপিসেন্টারটির আসল অবস্থান। কারণ, একটি ষ্টেশনকে কেন্দ্র ধরে এপিসেন্টারের দৈর্ঘকে ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অংকন করা হলে, এপিসেন্টার ঠিক কোন দিকে (এটি পূর্ব,পশ্চিম,উত্তর এবং দক্ষিণ) সেটি বের করা যায় না। কারণ বৃত্তের ব্যার্সার্ধ সবদিকেই সমান। এই সমস্যা সমাধান করার জন্য ৩ টি ষ্টেশনকে বৃত্তের কেন্দ্র ধরে এপিসেন্টারের দুরত্বকে ব্যাসার্ধ ধরে তিনটি বৃত্ত আঁকলে, বৃত্ত তিনটি যে বিন্দুতে ছেদ করে বা স্পর্শ করে যায়,ভু-পৃষ্টে সেই বিন্দুটিই ভুমিকম্পের এপিসেন্টার বা উপকেন্দ্র। ভালভাবে বোঝার জন্য নিচের চিত্র লক্ষ্য করুন:
ভূমিকম্পের মাত্রা
যখন পৃথিবীর কোন স্থানে প্রয়ংকারী ভুমিকম্প হয়, তখন সবাই যেটা জানতে চায়, সেটা হলো-ভুমিকম্পের উৎপত্তিস্থল এবং এর প্রচন্ডতা বা মাত্রা । দুই ধরনের স্কেল আছে ভুমিকম্পের মাত্রা এবং তীব্রতা পরিমাপের জন্য।
রিক্টারস্কেল
ভুমিকম্পের ব্যাপকতা বা ম্যাগনিটিউট মাপার জন্য রিক্টার স্কেল ব্যবহার করা হয় । এক কথায় ভুমিকম্পের ম্যাগনিটিউট বা মাত্রা হলো দীর্ঘতম ভু-কম্পন তরঙের আকার বা প্রশস্তরতার উপর ভিত্তি ভুমিকম্পের সময় নির্গত শক্তির পরিমাপ করা। রিক্টার স্কেল একটি লগ-স্কেল। এই স্কেলে ০ থেকে ১০ পর্যন্ত মাত্রা পরিমাপ করা যায়। রিক্টার স্কেলে একটি মাত্রা সাধারণত পূর্ববর্তী মাত্রা অপেক্ষা ১০ গুন বেশী । উদাহরণস্বরুপ, রিক্টারস্কেলে ৪.০ মাত্রাটি ৩.০ মাত্রা অপেক্ষা ১০ গুন বেশী এবং ২.০ মাত্রা অপেক্ষা ১০০ গুন বেশী। নীচের সারণীতে পৃথিবীতে কোন মাত্রার ভুমিকম্প কতসময় পরপর ঘটে তা দেখা যাক।
সংশোধিত মার্কাল্লি স্কেল
ভু-কম্পন তরঙের আকার-এর উপর ভিত্তি করে ভুমিকম্পের শক্তিমাত্রা আসলে সাধারণ জনগনের তেমন উপকারেআসে না। রিক্টারস্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা থেকে প্রকৃতপক্ষে ভুমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি সর্ম্পকে সঠিক ধারণা করা যায় না। রিক্টারস্কেলের এই অসুবিধার জন্য একটি বিকল্প স্কেল তৈরী করা হয়, যার সাহায্যে ভুমিকম্পের ইনটেনসিটি বা তীব্রতা পরিমাপ করা হয়। ভুমিকম্পের তীব্রতা হলো বিশাল এলাকা জুড়ে ভুমিকম্পের ফলে মানুষ্যনির্মিত ˉহাপনার ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়ন। সাধারণত ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ননার ভিত্তিতে মার্কাল্লি স্কেলে তীব্রতা পরিমাপ করা হয়।
নিচের সারণীতে উল্লেখ্য ইনটেনসিটি এবং রিক্টারস্কেলের মাত্রা এপিসেন্টার এবং এর আশেপাশে এলাকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
মোমেন্ট ম্যাগনিটিউট স্কেল
ভূমিকম্পের সময় কি পরিমান শক্তি নির্গত নির্গত হয়, তার উপর ভিত্তিকরে মোমেন্ট ম্যাগনিটিউট স্কেল তৈরী করা হয়েছে। মোমেন্ট বলতে বোঝা যায়, একটি ফল্ট বা চ্যূতি কি পরিমান সরে গেছে এবং এই সরে যাওয়ার জন্য কি পরিমান শক্তির প্রয়োগ হয়েছে।
দুভার্গ্যবশত, বহুল প্রচলিত রিক্টারস্কেলে অতি বড়মাত্রার ভূমিকম্পের প্রায় সঠিক পরিমাপ সম্ভব নয় আর অপরদিকে মোমেন্ট ম্যাগনিটিউট স্কেল বিভিন্ন মাত্রার ( ছোট থেকে অতি বড় মাত্রার) ভূমিকম্পের পরিমাপ সম্ভব। রিক্টারস্কেল এবং মোমেন্ট ম্যাগনিটিউট স্কেল-এ ছোট থেকে বড় মাত্রার পরিমাপ প্রায় একই কিন্তু, বিশাল এলাকাজুড়ে অতি বড় মাত্রার ভূমিকম্পের প্রায় সঠিক পরিমাপের জন্য মোমেন্ট ম্যাগনিটিউট স্কেল আর্দশ এবং বিশ্বব্যাপী সিসমোলজিষ্টদের কাছে আদরণীয়।
সূত্র: ইন্টারনেট , কপিরাইট : শুভ সালাতিন